জেলা কৃষি বিভাগের জনবল সংকটের কারণে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির সুফল ভোগ করতে পারছেন না হাওরপাড়ের কৃষকরা। যার ফলে প্রতি বছর নানান দুর্যোগের মোকাবেলা করতে গিয়ে হিমসিম খেতে হচ্ছে তাদের। জেলার ১১টি উপজেলায় কর্মকর্তা ও উপ-সহকারী কর্মকর্তার পদে শূন্যতা বিরাজ করছে দীর্ঘ দিন ধরে। ফলে কৃষি বিভাগ থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে ফসল উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছেন না হাওরপাড়ের লাখ লাখ কৃষক।বোরো ধান উৎপাদনে সমৃদ্ধ সুনামগঞ্জ পিছিয়ে আছে বোরো চাষেই।
জেলার তাহিরপুর, দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, মধ্যনগর, বিশ্বাম্ভরপুর এলাকার কৃষকরা প্রতিনিয়ত সমস্যায় পড়ছেন অথচ তার সমাধান পাচ্ছেন না, পাচ্ছেন না প্রয়োজনীয় পরামর্শ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ জেলায় নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সুবিধা মত এলাকায় নিয়োগ না পেয়ে যোগদান করেই বদলি হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগে পড়েন। আর বদলিও হয়ে যান নিজেদের পছন্দ মত এলাকায়। ফলে কৃষি বিভাগের এসব পদে শূন্যতা বিরাজ করছে জেলার সর্বত্রই। ফলে সঠিক সময়ে সঠিক কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কৃষি কৌশল বিষয়ক পরামর্শ না পাওয়ায় মান্ধাতা আমলের চাষাবাদ পদ্ধতিই অনুসরণ করে চলেছেন। ফলে এক ফসলি বোরো জমি চাষাবাদ করতে গিয়ে বীজ, কীটনাশক ও সারের বিষয়েও কোন মনিটরিং না থাকা, চারা লাগানো থেকে শুরু করে ধান কাটা পর্যন্ত প্রতি বছরই বন্যা, শিলা বৃষ্টি, খরা ও পোকার আক্রমণে জমির ধান নষ্ট হচ্ছে।
কৃষকদের অভিযোগ, হাওরাঞ্চলের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা (ব্লক সুপার ভাইজার) যারা কর্মরত আছেন তারা সপ্তাহে ৫দিন মাঠে গিয়ে কৃষকদের সকল সমস্যা ও সমাধান নিয়ে কাজ করার কথা থাকলেও এ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না। ওয়ার্ড পর্যায়ে যাদের কাজ করার কথা সেখানে না এসে বেশির ভাগ সময় উপজেলা সদরের অফিসে বসে থাকেন অথবা পরিবার-পরিজন নিয়ে শহরেই থাকেন।
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্য্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার জেলা কৃষি সম্প্রসারণ প্রধান কর্মকর্তা পদ শূন্য, জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা ২জন, কর্মরত আছে ১জন, অতিরিক্ত উপ-পরিচালক ৩টি পদের ৩টিই শূন্য রয়েছে। এছাড়াও ১১টি উপজেলায় অফিসার প্রর্যায়ে ৫জনে কর্মকর্তার স্থলে কর্মরত আছেন মাত্র ১জন। জেলায় ১১টি উপজেলায় উপ-সহকারী কর্মকর্তার পদ রয়েছে ২৬৩টি, আর কর্মরত আছে ১০৮জন। ফলে এ জেলায় কর্মকর্তা ও নির্দিষ্ট এলাকায় উপ-সহকারী কর্মকর্তা না থাকায় ও প্রয়োজনীয় কৃষি পরামর্শের অভাবে ফসল উৎপাদনে নানান সমস্যায় পড়ছেন হাওরাঞ্চলের লাখ লাখ কৃষক।
তাহিরপুর উপজেলার হাওরপাড়ের কৃষক সাদেক আলী, রমজান আলী, সবুজ মিয়ার মতন কৃষকেরা অভিযোগ করেন,‘আমরা কৃষি অফিসের কোন লোকের পরামর্শ পাই না। যার জন্য আমরা আমাদের মত করে পৈত্রিকভাবে শেখা পদ্ধতি আর বেশির ভাগ সময় বাজারের কীটনাশক, সার বিক্রেতার কাছ থেকেই কৃষি বিষয়ে পরার্মশ নিয়ে জমিতে কীটনাশক,সার দিয়ে থাকি এবং অন্যান্য সমস্যার সমাধান করি। কৃষি অফিসের লোকজনের মাধ্যমে আধুনিক যুগপযোগী সঠিক পরামর্শ পেলে আমরা লাভবান হতাম।’
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক পিযুস পুরকায়স্থ টিটু বলেন, ‘কৃষি একটি দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি, পরিবর্তিত আবহাওয়া ও জলবায়ুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারায় ফসল উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটছে প্রতি বছর। ফলে এ জেলায় গত কয়েক বছর ধরেই অকাল বন্যায় বোরো ধানসহ অন্যান্য ফসলের ব্যাপক ক্ষতির শিকার হচ্ছে। তারপরও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উদ্ভাবিত নতুন নতুন কৃষি প্রযুক্তি দ্রুত কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে গ্রাম প্রর্যায়ে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে তাদের নির্ধারিত জায়গায় থাকতে বাধ্য করতে হবে।’
অভিযোগ স্বীকার করে নিয়ে তাহিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুস ছালাম বলেন, ‘এ উপজেলায় জনবল সংকটই প্রধান সমস্যা। যার জন্য কৃষকদের সহায়তায় আমরা যারা আছি, তারাই কোন রকমে কৃষি সেবা দিয়ে যাচ্ছি সাধ্যমত। প্রয়োজনীয় জনবল থাকলে কৃষকদের সঠিক সময়ে সঠিক পরামর্শ দিতে সমস্যা হত না। জনবল শূন্যতার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বারবার জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি।’
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) স্বপন কুমার বলেন,‘জনবল সংকট জেলা ও সকল উপজেলায় রয়েছে। জনবল সংকটের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতি মাসেই লিখিতভাবে জানানো হচ্ছে। জনবল সংকট না থাকলে কৃষকদের সঠিকভাবে সঠিক পরামর্শ, সঠিক সময় দিতে পারতাম। জনবল না থাকায় এখন সমস্যা হচ্ছে। আমাদের জনবল কম, তারপরও যারা কর্মরত আছেন- তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে। যারা দায়িত্ব পালন করবে না তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’