যেসব ঘটনা সমাজে বসবাসকারী মানুষের আবেগীয় বা আর্থিক ক্ষতি সাধন করে থাকে এবং স্বাভাবিক জীবন যাপনে বাধার সৃষ্টি করে, তাকেই সামাজিক সমস্যা বলে। বর্তমানে বিবাহবিচ্ছেদের হার ক্রমাগত বাড়ায় তা এক সামাজিক সমস্যায় রূপ নিচ্ছে। রাজধানী ঢাকা শহরে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১ হাজার ১৯৪টি তালাক সংঘটিত হয়। গত জনশুমারি অনুযায়ী দেশে এসব বিবাহবিচ্ছেদের হার দশমিক ৪২ শতাংশ। এসব বিচ্ছেদের পেছনে মতের অমিল, নারীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন, পুরুষতান্ত্রিকতা ও সামাজিক নিয়মের বেড়াজাল, শারীরিক নির্যাতন, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, যৌতুকের দাবি, শারীরিক অসুস্থতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব ও প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং পারিবারিক অশান্তিসহ নানাবিধ কারণ জড়িয়ে আছে। এমন বিচ্ছেদে দম্পতিদ্বয় সুখী হলেও মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে পড়ে যায় সন্তানেরা। প্রথমেই তারা অভিভাবকত্ব নিয়ে সংকটে পড়ে। বিচ্ছেদের পর সন্তান বাবার কাছে থাকবে নাকি মায়ের কাছে থাকবে—এ নিয়ে চলে এক আইনি জটিলতা। এছাড়া তারা একাকিত্বে ভোগে; দেখা যায় স্বাভাবিক পরিবারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাবা-মা কেউ না কেউ বাচ্চাকে সময় দিচ্ছে, কিন্তু বিচ্ছেদের শিকার পরিবারে বাবা-মাকে ঘরের বাইরে কাজ করার ফলে বাচ্চাকে যথাযথ সময় দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এসব সন্তানের সুষ্ঠু সামাজিকীকরণও সম্ভব হয় না। কেননা, সন্তান বাবা-মায়ের দৈনন্দিনের কর্মকাণ্ড অনুসরণে নিজেদের তৈরি করে, যা এক্ষেত্রে তা বাধাগ্রস্ত হয়। সামাজিকভাবেও এসব সন্তানের গ্রহণযোগ্যতা কমে যায় অনেক ক্ষেত্রে। লোকমুখে কটু কথা শুনতে হয় তাদের, হেয়প্রতিপন্ন হয় বন্ধুমহলে; যখন বন্ধুরা তাদের বাবা-মায়ের গল্প শোনায়, তখন তারা নিশ্চুপ হয়ে যায়। পাশাপাশি বিচ্ছেদকালীন দেখা যায়, মায়ের পরিবারে বাবাকে নিয়ে কটু কথা আর বাবার পক্ষ থেকে মাকে নিয়ে নিন্দা শুনতে হয় সন্তানকে, যা তার মানসিক বিকাশে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করে। এছাড়া বিচ্ছেদ-পরবর্তী সময়ে যখন বাবা-মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়, তখন সেই সন্তানের জীবনে নেমে আসে আরেক দুর্বিষহ মুহূর্ত। বাবা-মায়ের জায়গায় অন্য এক জনের আধিপত্য মেনে নেওয়া সহজ হয় না তাদের পক্ষে। যার ফলে এসব বাচ্চা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, হারিয়ে যায় তাদের স্বাতন্ত্র্যবোধ, হয় না স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা, আচরণ হয় অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ঘটে না সুস্থ সামাজিকীকরণ। ফলে তারা অনেক সময় পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে ওঠে, হতাশা ও উদ্বিগ্নতায় ভোগে, লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়ে। এমনকি কখনো কখনো মাদকাসক্তের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তাই সন্তানদের সুন্দর আগামীর কথা চিন্তা করে একটা সুষ্ঠু পরিবেশে সুনাগরিক ও আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তোলার প্রয়াসে বাবা-মাকে বিচ্ছেদের আগে আরেক বার ভেবে দেখা উচিত। সংসার টিকিয়ে রাখতে পারস্পরিক উত্সর্গবোধ জাগিয়ে তোলা প্রয়োজন। এছাড়া বিয়ের সঙ্গে সঙ্গেই বাচ্চা না নিয়ে তাদের নিজেদের সম্পর্ক ভালো আছে কি না, তা নিশ্চিত করে বাচ্চা নেওয়া উচিত বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। আর যদি বিচ্ছেদ হয়েও যায়, সন্তানের ওপর যেন এর নেতিবাচক প্রভাব না আসে, তা নিয়ে সচেতন থাকতে হবে বাবা-মাকে। আর তাদের দিতে হবে প্রচুর সময়, যেন তারা মানসিকভাবে শক্তিশালী থাকে। সামাজিক মহলে আনতে হবে সচেতনতা। কেননা, বিবাহবিচ্ছেদকে আজও কটু চোখে দেখে এই সমাজ। প্রয়োজনে সরকারি-বেসরকারি, স্বেচ্ছাসেবী ও সুশীল সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগে জনসাধারণের মধ্যে এ নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে ওয়েবিনারের আয়োজন করাসহ অন্যান্য কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।