গৌরনদী (বরিশাল) প্রতিনিধিঃ আগেকার দিনে যখন কাঠ-কয়লায় বা উনুনে যখন রান্না করা হত, তখন মাটির হাঁড়ির চলটা ছিল সবচেয়ে বেশি। ধীরে ধীরে যুগের সঙ্গে রান্নার ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। সঙ্গে মাটির হাঁড়ির ব্যবহারও বেশ কমে গিয়েছে। কিন্তু গবেষণা বলছে মাটির হাঁড়িতে রান্না করলে সে খাবারের স্বাদ যেমন আলাদা হয়, তেমনই তা স্বাস্থ্যের পক্ষেও উপকারী।
বর্তমানে ভারতে মাটির হাঁড়িতে রান্নার চল থাকলে বাংলাদেশে এটি তেমন দেখা মেলে না। সম্প্রতি বরিশালে একটি রেস্টুরেন্টে মাটির হাঁড়িতে নানা ধরনের মুখরোচক খাবার তৈরি করতে দেখা গেছে। আর এসব খাবার খেতে প্রতিদিনিই ভিড় বাড়ছে ভোজন রসিকদের। বরিশাল এই প্রথম বারের মতো নগরীর চৌ-মাথা এলাকায় ‘এ্যারাবেল্লা’ নামে একটি রেস্টুরেন্টে এ আয়োজন করা হয়েছে।
ক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, বরিশালে নামি-দামি বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠলেও তেমন জমাতে পারেনি কেউ। খাবার আসল স্বাদ পেতে এখানে আসেন তারা।
সরেজমিনে দেখাগেছে, মাটির হাঁড়িতে এসব জিভে জল আনা এসব ব্যতিক্রমী রান্না খেতে প্রতিদিন ভোজন রসিকদের ভিড় লেগেই থাকে এই রেস্টুরেন্টে। এখানে মাটির হাঁড়িতে রান্না করা খাবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, মাটির হাঁড়িতে খাসি, গরু, হাঁস, মুরগীর মাংস রান্না ও মাটির হাড়িতে বিরিয়ানী রান্না। মাংস দিয়ে খাবার জন্য এখাতে তৈরি করা হয় চালের তৈরি রুটি।
নগরীর রুপাতলী থেকে এ রেস্টুরেন্টে হান্ডি বিফ (মাটির হাঁড়ির মধ্যে গরুর মাংস রান্না) ও হান্ডি বিরিয়ানী (মাটির হাঁড়ির মধ্যে বিরিয়ানী রান্না) খেতে এসেছেন সাথী খানম। তিনি বলেন, ‘বরিশালে আগে এধরনের খাবার খাইনি। স্বাদের তুলনা হয় না। মাঝে মধ্যেই এখানে খেতে আসি পরিবার নিয়ে।’
এ্যারাবেল্লা রেস্টুরেন্টের কর্মীরা বলেন, সকালে একটু কম চাপ থাকলেও বিকেল হলেই ক্রেতাদের ভিড় লেগেই থাকে। ক্রেতারা শুধু খেয়েই যান না, বাসা বাড়িতে পারিবারের জন্যও নিয়ে যান।
রেস্টুরেন্টটির প্রধান সেফ মোঃ বাচ্চু বলেন, ‘সাধারণ পাত্রে রান্না ও মাটির পাত্রে মধ্যে রান্নার পার্থক্য নিশ্চই জানা আছে। এদের মূল পার্থক্য স্বাদ আর পুষ্টি উপদানে। কাচ বা স্টিলের পাত্রের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাটির পাত্রের ব্যবহার প্রায় হারাতে বসেছে। তাই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা ও ক্রেতাদের ভালো মানের খাবার পরিবেশনের জন্য এ আয়োজন।’
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. কামরুজ্জামান বলেন, ‘মাটির পাত্র এক ধরনের ক্ষারীয় উপাদান দিয়ে তৈরি যা খাবারের অ্যাসিড প্রক্রিয়াজাতকরণে সাহায্য করে এবং হজমে সহায়তা করে। তাছাড়া মাটির পাত্রে রান্না করা খাবারে লৌহ, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও সালফারের মান বেশি থাকে।’
মাটির পাত্রে রান্নার উপকারিতা\ স্বাদ ও পুষ্টির বিবেচনায় সব ধরনের রান্নার জন্য মাটির পাত্র উপযোগী। আয়ুর্বেদশাস্ত্র অনুযায়ী, মাটির পাত্র রান্না ধীর করে এবং খাবারের স্বাদ ও মান উন্নত করে। মাটির পাত্রে রান্না করলে খুব সহজেই তেলের ব্যবহার এড়িয়ে যাওয়া যায়। কেননা এর প্রাকৃতিক আর্দ্রতা খাবার ভালোভাবে রান্না করার জন্য উপযোগী। মাটির পাত্র কাদা দিয়ে তৈরি করা হয়। যাতে প্রাকৃতিক ভাবে ক্ষারীযুক্ত হয়। তাপ প্রয়োগে মাটির পাত্র খাবারের অ্যাসিডের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে এবং পিএইচ’য়ের ভারসাম্য বজায় রাখে। যা খাবারকে সহজপাচ্য করে। তাছাড়া এটা খাবারের পুষ্টি উপাদান যেমন- লৌহ, ক্যালসিয়াম, ম্যাগ্নেসিয়াম এবং সালফার ঠিক রাখে। মাটির পাত্রে রান্নার আরেকটি ভালো দিক হল, এতে তেল কম লাগে। ধীর গতিতে রান্না ও তাপ নিরোধক হওয়ায় এটা খাবারের প্রাকৃতিক তেল ও আর্দ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও খাদ্যের পুষ্টিমান বজায় রেখে স্বাদ ও গন্ধ অক্ষুন্ন রাখে বা বাড়িয়ে দেয় মাটির পাত্র। যা অন্যান্য উপাদানের তৈজস দিয়ে সম্ভব নয়।