সৈয়দপুর (নীলফামারী) প্রতিনিধিঃ ‘বাড়ির সামনের এই জায়গাটুকু পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিলো, ময়লা ফেলতাম। গরু ছাগল বেঁধে রাখতাম, প্রসাব পায়খানা করতো। দুর্গন্ধ হতো। এখন এই জায়গাটুকুতেই অনেক ধরণের শাক সবজি হচ্ছে’।
কৃষি সুপারভাইজার ভাইয়ের বুদ্ধি পরামর্শ নিয়ে নিজের আঙ্গিনায় শাক সবজি উৎপাদন করতে পারছি। আমার বাগান থেকেই টাটকা সবজি সংগ্রহ করে খেতে পারছি।’ এই বাগান হয়ে অনেক ভালো হয়েছে।উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের ব্রক্ষ্মোত্তর কুতুপাড়া এলাকার আমজাদ হোসেনের স্ত্রী নার্গিস আক্তার। রবিবার (৭ আগস্ট) ব্রহ্মোত্তর গ্রামে গেলে তিনি সংবাদকর্মীদের এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, দেড় শতক জায়গা এখন আমার কাছে অনেক সম্পদ মনে হচ্ছে। লাউ, বেগুন, শিম, বরবটি, পেঁপে, ঝিংগা, চিচিংগা, করলা, কায়তা, পাটশাক, লালশাক, সবুজশাক প্রভৃতি আবাদ করছি।বাড়ির পাশের পরিত্যক্ত জায়গায় পারিবারিক পুষ্টি বাগান গড়ে তুলেছেন সরকারপাড়ার আফতাব উদ্দিনের স্ত্রী জোহরা বেগম।
তিনি বলেন, ‘এখন আর আমাদের বাজার থেকে শাক-সবিজ কিনতে হয় না। নিজেদের বাগানে শাক-সবজি জৈব সার দিয়ে চাষ করছি। এতে কোনো ধরনের রাসায়নিক সার কিংবা কীটনাশক ব্যবহার করছি না। মুরগির বিষ্ঠা, মাছের পানি, উচ্ছিষ্ট সার হিসেবে ব্যবহার করছি। ‘শুধু আমরা খাই তা কিন্তু নয়, অনেকে কিনে নিয়ে যান সবজি। পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার খাচ্ছি আমরা, এটাই বড় বিষয়।’
কোরানীপাড়া এলাকার দিনমজুর এনামুল হক। তিনিও বাড়ির পাশে দেড় শতক জায়গাজুড়ে গড়ে তুলেছেন সবজির বাগান। বলেন, ‘আমি চিন্তাও করিনি এতটুকু জায়গায় এত ধরনের ফসল ফলানো সম্ভব। কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও সহযোগিতায় এটি সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে স্থানীয় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোমিনুর মোস্তফা জামানের উদ্যোগেই এটি সম্ভব হয়েছে।’
‘তিনি আমাদের বীজ দিয়েছেন, কোথায় কী বীজ দিতে হবে, কিভাবে জাংলা (মাচান) দিতে হবে, সব শিখিয়ে দিয়েছেন। যার ফলে এ ধরনের বাগান করা সম্ভব হয়েছে।’ ৩৫টি বাড়ি নিয়ে গড়ে ওঠা ব্রোক্ষ্মোত্তরপাড়াটি এখন সবজি গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। যে কাউকে বললেই দেখিয়ে দেবে সবজি গ্রামের লোকেশন। এই এলাকার মানুষ এখন আর সরকারপাড়া, কোরানীপাড়া কিংবা কুতুপাড়ার মানুষ হিসেবে নন, পুষ্টি গ্রামের মানুষ হিসেবে পরিচিত।
ওই এলাকার বাসিন্দা পোষাক কারখানার শ্রমিক খাদিজাতুল জান্নাত বলেন, আমিও পারিবারিক পুষ্টি বাগান করার জন্য যোগাযোগ করছি কৃষি কর্মকর্তার সাথে। সামনের দিনে আমিও করবো। এর অনেক উপকারীতা দেখছি চোখের সামনে।
তিনি আরও বলেন, এলাকার রাস্তা দিয়ে হাঁটলে এখন আর প্রসাব, পায়খানা কিংবা নোংরা আবর্জনা চোখে পড়ে না। চোখে পড়বে লাউ, শিম, বরবটি, পেঁপে, বেগুন প্রভৃতির সবুজ দৃশ্য। সেইসাথে অনেক ধরণের ফুল ফলের সুবাস। ফলে একসময়ের দুর্গন্ধময় জায়গায় এখন সুরভিত পরিবেশ।
ব্রহ্মোত্তর ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোমিনুর মোস্তফা জামান বলেন, ‘চলতি বছরের শুরু থেকে পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন শুরু হয়। কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে প্রশিক্ষণ, বীজ ও সার দিয়ে পরিকল্পনামাফিক এ বাগান তৈরি করা হয়। এর সুফল পাচ্ছেন বাগান মালিক ও এলাকার বাসিন্দারা।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাগানের মালিকরা পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ শাক-সবজি গ্রহণ করতে পারছেন, উৎপাদনে মনোনিবেশ তৈরি হচ্ছে এবং সংসারের কাজের ফাঁকে তারা কৃষিতে সময় দিতে পারছেন। এটি কৃষি বিভাগের একটি সফলতা।’
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান আশা বলেন, বাংলাদেশ সরকারের কৃষি বিভাগের উদ্যোগে পারিবারিক পুষ্টি বাগান কার্যক্রমের মাধ্যমে বাড়ীর আশেপাশের পরিত্যক্ত, ময়লা আবর্জনাযুক্ত অপ্রয়োজনীয় জায়গা কৃষির আওতায় এনে কাজে লাগানো হয়েছে। এতে ছোট ছোট পরিসরেই নিজস্ব বাগানে নানা ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় সবজি, ফলের চাষ করে দরিদ্র ব্যক্তিরা বেশ উপকৃত হচ্ছেন।
তিনি বলেন, অনেকে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে উৎপাদিত শাক-সবজি ও ফল বিক্রি করছেন। এতে যেমন নিজের দৈনন্দিন ব্যয় কমেছে। তেমনি বাড়তি আয়ের ব্যবস্থাও হয়েছে। ফলে কারও কারও অভাব ঘুচানোর উৎস্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বাগান। আবার কেউ কেউ বাগানের মাঝেই ছোট গর্ত করে তাতে মাছ চাষ করায় আমিষের সাথে প্রোটিনেরও ঘাটতি পূরণ হচ্ছে। অর্থাভাবে যারা তরকারী ছাড়াই কোনরকমে লবন মরিচ দিয়ে ভাত খেয়ে দিনাতিপাত করতো তারাও এখন তিন বেলায়ই কোন না কোন শাক-সবজি দিয়ে খাবার খেতে পারছে।
তিনি আরও বলেন, ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই বেশ কিছু পাড়া মহল্লায় এই পারিবারিক পুষ্টি বাগান করা হয়েছে। এতে প্রায় শতাধিক পরিবার উপকৃত হয়েছেন। তাদের দেখে আরও অনেকেই নিজ আগ্রহে বাগান করছেন। সবাইকে আমরা বীজ, সার, কীটনাশক দেয়াসহ প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সার্বিক সহযোগীতা করছি। অনেককে চাষ বিষয়ে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে সফল কৃষক হিসেবে গড়ে তুলেছি। আশাকরি এই উদ্যোগ কৃষি বিপ্লব হিসেবে পরিগণিত হবে এবং সাফল্যের স্বাক্ষর রাখবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহিনা বেগম জানান, ‘উপজেলায় ৬০০টি পারিবারিক পুষ্টি বাগান করার পরিকল্পনা রয়েছে। এরই মধ্যে ২৮৬টি বাগান তৈরি হয়েছে। কামার পুকুর ইউনিয়নের ব্রহ্মোত্তরপাড়ায় ৩৫টি পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন করা হয়েছে। এলাকাটি এখন পুষ্টি গ্রাম হিসেবেই পরিচিত।
ওই এলাকার বাসিন্দারা এখন নিরাপদ সবজি গ্রহণ করছেন। সরকারিভাবে বীজ, সার ও চারা দেয়া হচ্ছে। শাক-সবজির পাশাপাশি কমলা, পেয়ারা, মাল্টা ও লেবুও উৎপাদন করছেন বাগানিরা।