নেত্রকোণা প্রতিনিধি : নেত্রকোণায় বিলুপ্তির পথে গ্রাম-বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের মাটির ঘর। যা শীতে উষ্ণতা, গরমে শীতলতা দেয় আর চোর-ছ্যাচোড় প্রতিরোধক। নির্মান ব্যয় সাধ্য সীমায়, টেকসই ও মজবুত। এতো সব সুযোগ সুবিধে সত্বেও গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের মাটির ঘরের এখন আর কদর নেই। ফলে বিলুপ্তির পথে আবহমান বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের মাটির ঘর।
আবহমান গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের মাটির ঘর এখন বিলুপ্তির পথে। গ্রামের বৃক্ষ লতায় ঘেরা এ সব ঘরের জায়গা দখল করছে এখন আধা পাকা ভবন কিংবা সৌখিন ডুপ্লেক্স বাড়ী। অথচ বাঙ্গালীর মাটির ঘরের প্রাচীন ঐতিহ্য অনস্বীকার্য। কতো সৌখিন নান্দনিক সুসজ্জিত ছিলো সে মাটির ঘর। যেনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবি একেকটি। ছবির মতোই ঝকঝকে তকতকে ঘর। ঘরের দেয়াল জুড়ে আবার নানান রকমের ফুলেল নক্সা কোন কোনটার। লতাপাতার কারুকার্যও বিদ্যমান কোনটাতে। চালার নীচে কবুতরের খোঁপ। দিনরাত বাকুম বাকুম তাতে। ঝকঝকে তকতকে আঙ্গিনায় ছানা সমেত মুরগী কতেক।
শীতের প্রত্যুষে-সন্ধ্যেয় কুয়াশার চাদরে ঢাকা। দেখে মনে হয়, একেকটি সুখী গেরস্থ পরিবার যেনো। উদাত্তু আহবান যেনো সেখানে, ‘আমার বাড়ী আইসো ভোমর বসতে দেবো পিঁড়ে / জল পান যে করতে দেবো শালি ধানের চিড়ে/ শালি ধানের চিঁড়ে দেবো বিন্নি ধানের খই। আজ সেসব হারাতে বসেছে। মাটির ঘরের আরামের আর কোন কদর নেই। তার জায়গা দখল করেছে ইটের তৈরি সুউচ্চ পাকা ভবন। গ্রামের বৃক্ষলতার মাথা ডিঙ্গিয়ে বেয়াদবের মতোন আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে পড়ছে দিনদিন। এ যেনো রবি ঠাকুরের’ ইটের পরে ইট, তার মাঝে মানুষ কীট। নেইকো প্রেম নেইকো ভালোবাসা।
শুক্রবার (১৫ জুলাই ) নেত্রকোণা জেলা শহর থেকে মোটর বাইকে কলমাকান্দা উপজেলার সীমান্ত,রংছাতী পাচঁ গাঁও, খারনৈ, নলচাপড়া , বড়দল, লেংগুরা, সহ ৭/৮ টি গ্রাম ঘুরে এ রকম নিরন্তর আয়োজন চোখে পড়েছে। রাঙ্গা মাটির পথে ঘুরে ঘুরে দেখা গেলো মাটির মানুষ যেনো প্রাচীন ঐতিহ্যের মাটির ঘরগুলো ভাঙ্গতে উম্মাদ হয়ে লেগেছে। তার জায়গায় ইটের আধাপাকা কিংবা পাকা ভবন গড়তে আদাজল খেয়ে লেগেছে যেনো সবাই। সর্বত্র নগরায়নের ছোঁয়া লাভে মানুষ যেনো পাগল পারা হয়ে উঠেছে। ব্যতিক্রমও মিলেছে কিছু।
বড়ুয়াকোনা গ্রামের ইসলাম উদ্দীন-মমতা দম্পতি স্বপরিবারে ঢাকায় থাকেন। তারা পৈত্রিক মাটির ঘরটিকে সংস্কার করে নিচ্ছেন। ঘরটির খোল নলচে সব ঠিক রেখে বারান্দায় গ্রীল লাগাচ্ছেন, মেঝেতে বসাচ্ছেন টাইলস,আরো কিছু। দোতলা মাটির ঘর। মাটির কাঠামো। সব ঠিক আছে। আধুনিক সুযোগ সুবিধের সংযোজন হচ্ছে সাথে, মন্দ কি তাতে, এ রকম কিছু ব্যতিক্রম চোখে পড়ে শতকরা ৯০টি মাটির ঘর ভাংচুরের বিপরীতে। বড়দল গ্রামের এক মসজিদের সামনে আলাপ হলো কয়েক জন বয়স্ক গ্রামবাসীর সাথে। মাটির ঘর নিয়ে কথা হয় সেখানে। তাদের বক্তব্য, মানুষ হুজুগে মেতেছে। মাটির ঘরের সুবিধের নেই।
লেংগুরা গ্রামের এক স্কুল শিক্ষক মন্জুরুল হক স্বপরিবারে মাটির ঘরের বাসিন্দা। তিনি জানান, যত্নে থাকলে একশ’ বছরেও এ ঘরের কিছুই হয় না। ঘরগুলোকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বলা যায়। তবে মাটির ঘরের কারিগর পাওয়া এখন কঠিন।
তবে একই চিত্র দূর্গাপুর উপজেলার চিনা মাটির এলাকাখ্যাত চুলা, ভবাণীপুর,চন্ডিগড়, বিজয়পুর, এলাকায়। এই এলাকাগুলোতে সুন্দর ছবির মতো মাটির ঘরের আধিক্যে চোখ জুড়োত। এখন সেসব বিলুপ্তির পথে। বিজয়পুর গ্রামের হামিদুর রহমান জানান, পিতার আমল থেকেই মাটির ঘরে বসবাস তার। এখনো তাই আছেন। মাটির ঘরে নানা দিক তুলে ধরে তিনি জানান, বিদেশ গিয়ে নব্য বড়লোক বনে যাওয়া লোকজনের হাতেই মাটির ঘরের বিনাশ বেশী ঘটছে।
তিনি জানান, মাটির ঘরে থাকতেই পছন্দ তার। আর তাই থাকছেনও তিনি। এই সব মাটির ঘরের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের প্রতি সর্ব মহলের দাবী। না হয় আগামী প্রজন্মকে এই ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর ছবিতে একে দেখাতে হবে।