আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকে যারা নিজেদের কর্তব্য বলে ভাবেন তারাই মুমিন। তাকেই মুমিন বলে যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর একাত্মবাদ ও রসুল (সা.)-এর রিসালাত পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে বিশ্বাস করে এবং তাঁর প্রতিটি হুকুম-আহকাম মেনে চলে।
মহান আল্লাহ, তাঁর প্রেরিত সব নবী-রসুল, ফেরেশতা, আসমানি কিতাব, পরকাল ও তাকদিরের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে আর ইমান গ্রহণের পর যে ব্যক্তি ইমান থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি তিনিই প্রকৃত মুমিন। আল কোরআন ও হাদিসে মুমিনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ওইসব মুমিনই সফলকাম হয়েছে যারা নিজেদের নামাজে বিনয়-নম্র, যারা অনর্থক কথাবার্তায় নির্লিপ্ত ও বিতৃষ্ণ, যারা জাকাতদানে তৎপর, যারা নিজেদের যৌনাঙ্গ সংযত রাখে, তবে তাদের স্ত্রী ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে সংযত না রাখলে তারা তিরস্কৃত হবে না, তারপর কেউ এদের ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা সীমা লঙ্ঘনকারী হবে এবং যারা আমানত ও অঙ্গীকার সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকে এবং যারা তাদের নামাজসমূহের হেফাজত করে তারাই উত্তরাধিকার লাভ করবে, তারা ছায়াময় সুশীতল উদ্যানের উত্তরাধিকার লাভ করবে, তারা তাতে চিরকাল থাকবে।’ সুরা মুমিনুন আয়াত ১-১১।
কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘প্রকৃত ইমানদার তো তারাই আল্লাহর জিকির হলে যাদের অন্তর কেঁপে ওঠে। আর আল্লাহর আয়াত যখন তাদের সামনে পড়া হয় তাদের ইমান বেড়ে যায়।’ সুরা আনফাল আয়াত ২। একজন মুমিন আল্লাহর ওপর ইমান আনার পর আর কখনো এ বিষয়ে আস্থার সংকটে ভোগে না। সে পূর্ণভাবে আল্লাহর ওপর আস্থাশীল হয়।
যেমন আল্লাহতায়ালা নিজেই বলেছেন, ‘মুমিন তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা.)-এর প্রতি ইমান আনার পর আর সন্দেহে পড়ে না।’ সুরা হুজুরাত আয়াত ১৫। ‘তারা আল্লাহ ছাড়া আর কোনো প্রভুকে ডাকে না।’ সুরা ফুরকান আয়াত ৬৮।
কোরআনে আল্লাহ মুমিনদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেন, ‘যারা মুমিন আল্লাহর স্মরণে তাদের অন্তর প্রশান্তি লাভ করে। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরে প্রশান্তি এসে থাকে। জেনে রেখ, আল্লাহর স্মরণ আসলে তা যার দ্বারা দিল পরম শান্তি ও স্বস্তি লাভ করে।’ সুরা রাদ আয়াত ২৮।
মুমিনরা সত্যনিষ্ঠ হয়। কোনো তথ্য পেলে তারা তা যাচাই করে গ্রহণ করে। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! যদি কোনো পাপাচারী তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে তবে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও। এরপর নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও।’ সুরা হুজুরাত আয়াত ৬।
মুমিনদের বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা মুমিনদের পারস্পরিক দয়া, ভালোবাসা ও হৃদ্যতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে একটি দেহের মতো দেখতে পাবে। দেহের কোনো অঙ্গ যদি পীড়িত হয়ে পড়ে তাহলে অন্য অঙ্গগুলোও জ্বর, নিদ্রাহীনতাসহ তার ডাকে সাড়া দেয়।’ বুখারি।
আল কোরআনে মুমিন পুরুষ ও নারী সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আর ইমানদার পুরুষ ও ইমানদার নারী একে অন্যের সহায়ক। তারা সৎ কাজের আদেশ দেয় এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত আদায় করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করে। এদের ওপর আল্লাহ দয়া করবেন।’ সুরা তওবা আয়াত ৭১।
মুমিনকে মহব্বত ও দয়ার প্রতীক বলা হয়। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই সৎকর্মশীল মুমিনদের জন্য দয়াময় আল্লাহ তাদের জন্য (মানুষের অন্তরেও) মহব্বত পয়দা করে দেন।’ সুরা মরিয়ম আয়াত ৯৬।
রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মুমিন মহব্বত ও দয়ার প্রতীক। ওই ব্যক্তির মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই যে কারও সঙ্গে মহব্বত রাখে না এবং মহব্বতপ্রাপ্ত হয় না।’ মুসনাদে আহমাদ।
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘ওই ব্যক্তি তার ইমানকে দৃঢ় করল যে কাউকে ভালোবাসল আল্লাহর জন্য, কাউকে ঘৃণা করল আল্লাহর জন্য। কাউকে কোনো কিছু দিল আল্লাহর জন্য আর কাউকে কোনো কিছু দেওয়া থেকে বিরত থাকল কেবল আল্লাহর জন্য।’ তিরমিজি।
আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহ, তাঁর রসুল ও তোমাদের ওপর ন্যস্ত আমানতের খিয়ানত কোর না। অথচ তোমরা এর গুরুত্ব খুব ভালো করেই জান।’ সুরা আনফাল আয়াত ২৭। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যদি তোমার মধ্যে চারটি জিনিস থাকে তবে পার্থিব কোনো জিনিস হাতছাড়া হয়ে গেলেও তোমার ক্ষতি হবে না- ১. আমানতের হিফাজত ২. সত্যভাষণ ৩. উত্তম চরিত্র ৪. পবিত্র রিজিক।’ মুসনাদে আহমাদ।
অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রসুল (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘যে ব্যক্তি তোমার কাছে আমানত রেখেছে তার আমানত তাকে ফেরত দাও। যে ব্যক্তি তোমার আমানত আত্মসাৎ করে তুমি তার আমানত আত্মসাৎ কোর না।’ তিরমিজি, আবুদাউদ।
কোরআন ও হাদিসের নিরিখে মুমিন হবেন আমানতের রক্ষণাবেক্ষণকারী। মুমিন কখনো খিয়ানতকারী হতে পারে না। এটা মুমিনের চরিত্রের বিপরীত কাজ। নিজেদের মুমিন হিসেবে আল্লাহর দরবারে উপস্থাপন করতে হলে এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আল্লাহ আমাদের মুমিনের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি রপ্ত করা এবং মুমিন হিসেবে তাঁর দরবারে হাজির হওয়ার তৌফিক দিন।